গিমা শাক খেলে কি হয়? গিমা শাক এর উপকারিতা ও অপকারিতা
অতি প্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম গঞ্জের মানুষের কাছে অনেক সুপরিচিত একটি শাকের নাম গীমা। অঞ্চল ভেদে গিমা শাককে বা ঢিমা শাক,গিমে শাক বা জিমা শাক নামেও ডাকা হয়। গিমা শাক এর বৈজ্ঞানিক নাম Glinus Oppositifolius। ইংরেজিতে গিমা শাককে Jima,Gima,Dime shak, Maita, Bitter Cumin,Indian Chickweed, Maitakaduri shak, Kangkong ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। হাট বাজারে গীমা শাক খুব একটা চোখে না পড়লেও, বাংলাদেশের সর্বত্রই এই শাক চোখে পড়ে। আসুন আমাদের সুপরিচিত গিমা শাক খেলে কি হয়? গিমা শাক এর উপকারিতা ও অপকারিতা-ই বা কি সে বিষয়ে সবিস্তারে জানার চেষ্টা করি।
গিমা শাক এর উপকারিতা (Gima Shak Benefits)
লিভার সুরক্ষায় গিমা শাকঃ
গিমা শাক লিভার সুরক্ষায় কাজ করে। ইঁদুরের উপর এক গবেষণায় দেখা গেছে গিমা শাকের মিথানল এক্সস্ট্রাকট লিভার ডেমেজ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। অন্য আরেক গবেষণায় দেখা গেছে গিমা শাক SGPT,SGOT, Total Billirubin, Direct Billirubin এর মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
হাইপার লিপিডিমিয়া বা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেঃ
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে গিমা শাক এর জলীয় ও মিথানল এক্সট্র্যাক্ট ডায়াবেটিস আক্রান্ত হাইপার লিপিডিমিক রোগীর লিপিড প্রোফাইল স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গিমা শাক রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল যেমনঃ টোটাল কোলেস্টেরল, ট্রাই গ্লিসারাইড, LDL-এর লেভেল স্বাভাবিক রাখতে ও ভাল কোলেস্টেরল HDL এর লেভেল বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
আরও পড়ুনঃ পুষ্টিকর গিমা শাকের ভাজি রেসিপি
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করেঃ
গিমা শাক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে দুরারোগ্য রোগ ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গীমা শাকের জলীয় অংশে থাকা পেকটিন টাইপ দুই ধরনের পলিস্যাকারাইড GOA1 এবং GOA2 উভয়ই chemotaxis of macrophages, T cells এবং NK cells এর প্রয়োজনীয় কার্যকারিতা কে প্ররোচিত করে।
সামারিঃ গিমা শাক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে দুরারোগ্য রোগ ক্যান্সার,লিভার এর রোগ, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখে।
গিমা শাক ছত্রাক প্রতিরোধীঃ
গিমা শাকের পাতা ও পুরা গাছের রস Candida albicans গোত্রের ছত্রাকের বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর। বিশেষ করে Methylene chloride বা Dichloromethane এর সাথে একত্রে Candida albicans গোত্রের ছত্রাক নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গিমা শাক অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল হিসেবে কার্যকরীঃ
গবেষণায় দেখা গেছে গিমা শাক norfloxacin এর মত এন্টিবায়োটিকের সাথে তুলনায় Bacillus subtilis, Staphylococcus aureus, Pseudomonas aeruginosa, Escherichia coli, এবং Aspergillus niger এই চার ধরনের গ্রাম পজিটিভ মাইক্রোব এর বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধীঃ
গিমা শাকের এন্টি প্লাজমোডিয়াম কার্যকারিতার উপর এক গবেষণায় দেখা গেছে- Plasmodium falciparum নামক ম্যালেরিয়ার জীবাণুর উপরে গীমা শাক বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
সামারিঃ গিমা শাক অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল হিসেবে কার্যকরী।সেই সাথে ছত্রাক ও ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধী
মশার লার্ভা ধ্বংসকারী হিসেবে কার্যকরঃ
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে গীমা শাকের পুরো অংশ Dichloromethane এবং Methanol এক্সট্রাক্ট কিউলেক্স ও এনাফিলিস মশার লার্ভা ১০০ ভাগ কার্যকারিতার সাথে ধ্বংস করতে সক্ষম। আমরা জানি কিউলেক্স ও এনাফিলিস যথাক্রমে গোদ ও ম্যালেরিয়া রোগের জন্য দায়ী।
গিমা শাক ক্রিমি নাশক হিসেবে কার্যকরঃ
গিমা শাক প্রাকৃতিক কৃমি নাশক হিসেবে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে অ্যালবেনডাজল নামক প্রচলিত কৃমিনাশক এর সাথে তুলনায় ভার্মিসাইডাল কার্যকারিতা প্রদর্শনে বেশ কার্যকরী।
গিমা শাক ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে কাজ করেঃ
বহু প্রাচীনকাল থেকে উপমহাদেশে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে গীমা শাক ব্যথা ও প্রদাহ নাশকারি ঔষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আধুনিক গবেষণায় ও দেখা গেছে গীমা শাক Peripheral এবং Central একটিং Analgesic ওষুধ হিসেবে কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে।
আরও পড়ুনঃ আপনি কি জানেন? পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা কি?
গিমা শাক এন্টিঅক্সিডেন্ট এর খুব ভালো উৎসঃ
গীমা শাকে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করে। সেই সাথে সাথে গীমা শাকে থাকা ভিটামিন সি ও ক্যারাটোনয়েড নামক এন্টিঅক্সিডেন্টের প্রভাবে শরীরে ফ্রি র্যাডিকেল তৈরি হতে পারে না।যার ফলে শরীরে ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য রোগ বাসা বাঁধতে পারে না।
গিমা শাক ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য কার্যকরঃ
সাম্প্রতিক সময়ে ইঁদুরের উপরে পরিচালিত অনেক গবেষণায় দেখা গেছে গিমা শাক এর মিথানল এক্সট্র্যাক্ট ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রচলিত ডায়াবেটিসের ওষুধ Metformin এবং Glibenclamide এর সাথে তুলনায় বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। আর গিমা শাক এর ইথানল এক্সট্র্যাক্ট প্রচলিত ডায়াবেটিসের ওষুধ Glibenclamide এর সাথে তুলনায় বেশ কার্যকরী হাইপোগ্লাইসেমিক কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে।
সামারিঃ ব্যথা ও প্রদাহ নিরাময় কারী এন্টিঅক্সিডেন্ট এ ভরপুর গিমা শাক ডায়াবেটিসের রুগীদের জন্য ও খুব উপকারী ।
গিমা শাক হারপিস জোসটার ও হার্পেনজিয়া রোগে কার্যকরীঃ
বহু প্রাচীনকাল থেকে ট্রাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা TCM এ হারপিস জোসটার ও হার্পেনজিয়া নামক ভাইরাস জনিত রোগে সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষত গিমা শাকের রস ওষুধ আকারে খাওয়ানোর মাধ্যমে রোগীকে খুব দ্রুত সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
গিমা শাক সাধারণ জ্বর কাশি ও অরুচি প্রতিরোধে বেশ কার্যকরঃ
বহু প্রাচীনকাল থেকে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে গীমা শাক সাধারণ জ্বর কাশি নিরাময়ে ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এছাড়াও বিভিন্ন রোগ থেকে ওঠার পরে মানুষের যে অরুচি বা ক্ষুধামন্দা ভাবের সৃষ্টি হয় সেটা নিরাময়ের মাধ্যমে মুখের রুচি ফেরাতে গিমা শাকের জুড়ি মেলা ভার।
গিমা শাক কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করেঃ
গিমা শাকে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। যার ফলে কোলন পরিষ্কার থাকে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হয় না। এর ফলে পেটের বাওয়েল মুভমেন্ট ঠিক থাকে ও পেটে বায়ু বা গ্যাস জমতে পারে না।
রক্ত বর্ধক হিসেবে কার্যকরঃ
প্রাপ্তবয়স্কদের হিমোগ্লোবিন ও সিরাম ফেরিটিন লেভেলের সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে গিমা শাক কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
সামারিঃ রক্ত বর্ধক ও কোষ্ঠকাঠিন্য এর জম গিমা শাক সাধারণ জ্বর কাশি ও অরুচি প্রতিরোধের পাশাপাশি হারপিস জোসটার ও হার্পেনজিয়া রোগে ও কার্যকর।
গিমা শাক এর অপকারিতাঃ (gima shak side effect)
গিমা শাক এর অপকারিতা তেমন নেই বললেই চলে। তবে পুষ্টিবিদ গন গিমা শাক বেশি পরিমাণে খেলে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন যা নিম্নরুপঃ
- বমি ও বমি ভাব
- ডায়রিয়া
- যাদের গিমা শাকে Allergic sensitivity থাকে তাদের ক্ষেত্রে Allergic সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের গিমা শাক খেলে সমস্যা হতে পারে। তাই পরিহার করাই ভাল।
গিমা শাক এর পুষ্টিগুণঃ
প্রতি ১০০ গ্রাম গিমা শাকে থাকেঃ
ক্যালোরি | ২২ কিঃক্যাল |
শর্করা | ১.৬ গ্রাম |
ফ্যাট | ০.৬২ গ্রাম |
খাদ্য আঁশ | 8 গ্রাম |
প্রোটিন | ২.২৯ গ্রাম |
ক্যারোটিনয়েডস | ৭৯৬ মাইক্রোঃগ্রাম |
ভিটামিন সি | ৭.০৩ মিলিঃগ্রাম |
এছাড়াও গিমা শাকে ভিটামিন বি১, বি২, ই ও ফসফরাস,ক্যালসিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, এবং ম্যাংগানিজ থাকে।
শেষ কথাঃ
গিমা শাক পুষ্টি ও উপকারিতায় অনন্য। বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা থেকে পরিত্রাণে গিমা শাক অনন্য ভূমিকা রাখে। স্বাস্থ্যে ও পুষ্টির বিভিন্ন দিক বিবেচনায় গিমা শাক খাওয়া উচিত। পুষ্টিতে ভরা এই দেশীয় শাকটি আমাদের প্রতিটি বাঙালির টেবিলে প্রায়ই থাকুক, এই প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি।
গিমা শাক খেলে কি হয়? এই প্রশ্ন ও এর উত্তর সম্পর্কিত আমাদের আর্টিকেলটি কেমন লাগলো কমেন্ট সেকশনে জানাতে ভুলবেন না। এছাড়াও আর কি কি বিষয়ের উপরে আর্টিকেল চান তাও জানাতে পারেন। আপনার সুচিন্তিত মতামত আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে।
FAQ
গিমা শাক খেলে কি হয় ? এই সম্পর্কিত সাধারণ কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
source1: Photo credit: J.M.Garg – https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=7767780
source3: https://www.tandfonline.com/doi/full/10.3109/13880209.2013.876653#abstract
source4: https://onlinelibrary.wiley.com/doi/10.1155/2016/8541017
এই তথ্য শুধুমাত্র শিক্ষা এবং সচেতনতার উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়। এটি কোনও স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার দ্বারা চিকিৎসার বিকল্প নয় এবং কোনও মেডিকেল অবস্থার নির্ণয় বা চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। তথ্যের যথাযথতা নির্ধারণের জন্য এবং কোন ঔষধ গ্রহণের আগে পাঠকদের একজন নিবন্ধিত চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত। pustibd.com তথ্যের সঠিকতা, পর্যাপ্ততা, সম্পূর্ণতা, বৈধতা, নির্ভরযোগ্যতা বা উপযোগিতা সম্পর্কিত কোনও গ্যারান্টি বা ওয়্যারেন্টি (স্পষ্ট বা উহ্য) সরবরাহ করে না; এবং এর উদ্ভূত কোনও দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে।