পাট শাক এর উপকারিতা কি জানেন?
প্রাচিনকাল থেকেই পাট শাক উপমহাদেশ তথা ভারত ও বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয়। যদিও আদিকাল থেকেই এশিয়া ও আফ্রিকায় পাট শাক খাদ্য ও টেকসই পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অঞ্চলভেদে পাট শাক এডেউ, আয়োয়ো, রাউ ডে ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
পাট শাকের স্বাধ সাধারণত কিছুটা তেতো হয়। তবে এর স্বাধ পাতার বয়সের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। কম বয়সী পাতা তুলনামূলকভাবে নরম ও সুস্বাদু হয়, আর বেশি বয়সী পাতা কিছুটা শক্ত, তেঁতো ও আঁশযুক্ত হয়ে থাকে।
এর পিচ্ছিল গঠনের কারণে বহু দেশে পাট শাক সাধারণত স্যুপ, স্টু ও তরকারির ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এর বহুমুখী ব্যাবহারের কারনে পাট শাক তাজা, শুকনো বা হিমায়িত অবস্থায় সহজেই সংরক্ষন করা যায়।
আসুন এই আর্টিকেলে পাট শাক এর উপকারিতা, পুষ্টিগুণ, ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
পাট শাকের উপকারিতা ও অপকারিতাঃ
পাট শাকের উপকারিতা অনেক। নিম্নে পাট শাকের উপকারিতা ও অপকারতা সবিস্তারে তুলে ধরা হল। যা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কিত আমাদের জ্ঞান কে আরও ক্ষুরধার করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

পাট শাক এর উপকারিতা (What are the benefits of Pat shak?)
রান্নার কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি পাট শাক শতাব্দী ধরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
নিম্নে রান্না করা পাট শাক এর উপকারিতা উল্লেখ করা হলঃ
পাটের শাক প্রদাহ কমাতে সহায়তা করেঃ
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং শরীরে প্রদাহ কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সাধারণত ওমেগা-৩-এর প্রধান উৎস হিসেবে চর্বিযুক্ত মাছ, বাদাম ও উদ্ভিজ্জ তেলকে মনে করা হয়।
তবে কিছু শাক সবজিতেও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়, পাট শাক তার অন্যতম উদাহরণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পাট শাকে অন্যান্য সবজির তুলনায় সর্বাধিক পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছ।
পাট শাকে মূলত আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (ALA) থাকে। যা শরীরে ইকোসাপেন্টানোইক অ্যাসিড (EPA) ও ডোকোসাহেক্সানোইক অ্যাসিড (DHA)-এ রূপান্তরিত হয়। এগুলো শরীরের জন্য সক্রিয় ও প্রয়োজনীয় ওমেগা-৩ সরবরাহ করে থাকে।
তবে, এই আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (ALA) এর রূপান্তর হার খুব কম, মাত্র ৫-৮%, তাই পাট শাককে প্রধান ওমেগা-৩ উৎস না ভেবে, পরিপূরক উৎস হিসেবে গণ্য করা উচিত।
এছাড়াও, পাট শাকে লাইকোপেন নামক একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। যা কোষকে অক্সিডেটিভ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে রান্না করা পাট শাক ও শুকনো পাতা তুলনামূলকভাবে বেশি লাইকোপেন ধারণ করে।
পাট শাক লিভারের প্রদাহ কমাতেও ভূমিকা রাখে। এক গবেষণায় দেখা গেছে ৩০ দিন ধরে প্রতিদিন পাট শাক খাওয়া ইঁদুরের লিভারের অবস্থা পূর্বের থেকে উন্নত হয়েছে। প্রাথমিক ফলাফল আশাব্যঞ্জক। যদিও এই গবেষণাগুলো প্রাণীদের উপর পরিচালিত হয়েছে, তাই মানবদেহে এর প্রভাব নির্ধারণে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
সারাংশঃ পাট শাকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও লাইকোপেন রয়েছে। যা শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এটি কোষকে অক্সিডেটিভ ক্ষতির থেকে রক্ষা করে ও রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, পাট শাক লিভারের প্রদাহ কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
পাটের শাক হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়তা করেঃ
পাট শাকে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে। যা দৈনন্দিন শারীরিক কার্যক্রম ঠিক রাখতে ও হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী হাড় ও দাঁত গঠনে এই দুটি খনিজ পদার্থ একসঙ্গে কাজ করে।
১ কাপ (৮৭ গ্রাম) রান্না করা পাট শাকে:
- ১৮৪ মি.গ্রা ক্যালসিয়াম ( যা দৈনিক প্রয়োজনের ১৪%)
- ৫৪ মি.গ্রা ম্যাগনেসিয়াম ( যা দৈনিক প্রয়োজনের ১৩%)
ক্যালসিয়াম হল শরীরের সর্বাধিক পরিমাণে থাকা খনিজ পদার্থ। এটি মূলত আমাদের শরীরের হাড় ও দাঁতে সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে। তবে ম্যাগনেসিয়াম ও ভিটামিন-ডি ছাড়া হাড় পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে না।
একটি বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার- ধরুন আপনি দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ মাত্রায় ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলেন কিন্তু সাথে কম ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণ করলেন। ফলশ্রুতিতে আপনার শরীরের অ-শোষিত ক্যালসিয়াম রক্তনালী ও কিডনিতে জমা হতে থাকবে। যা কিডনিতে পাথর এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে।
এছাড়াও, অসমতুল্য ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অনুপাত অস্টিওপরোসিসের (হাড়ের ক্ষয়) ঝুঁকি বাড়াবে। কারণ এই অবস্থায় হাড় প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে না।
তাই বলা যায় শরীরে সঠিক ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে ২:১ অনুপাতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণ করা সবচেয়ে উপকারী। তাই সেই দিক থেকে চিন্তা করলে পাটের শাক ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামে ভারসাম্যপূর্ণ একটি পরিপূরক খাবার।
তবে মনে রাখা জরুরি, ভিটামিন D ও ভিটামিন K-ও হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পাট শাকে এই দুটি পুষ্টি উপাদান নেই।
সারাংশঃ পাট শাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে, যা হাড়ের গঠন ও স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। সঠিক অনুপাতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকায় এটি হাড়ের ক্ষয় ও কিডনি পাথরের ঝুঁকি কমায়।
পাটের শাক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করেঃ
আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ ও রোগ থেকে রক্ষা করে। এটি সঠিকভাবে কাজ করতে হলে প্রয়োজন সঠিক পুষ্টি উপাদানের। পাট শাক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। কারণ এতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

পাট শাকে থাকা ভিটামিন C শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টঃ
ভিটামিন C এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা শরীরকে অক্সিডেটিভ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। এই ক্ষতি স্ট্রেস, দূষণ, বিভিন্ন ঔষধ, জীবনযাত্রার প্রতি খেয়াল না রাখা ও দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন রোগের কারণে হয়। ।
১ কাপ (৮৭ গ্রাম) রান্না করা পাট শাকে ২৮.৭ মিগ্রা ভিটামিন C থাকে। যা প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক প্রয়োজনের ৩২% পূরণ করতে সক্ষম। যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন C গ্রহণ সংক্রমণ প্রতিরোধী ও রোগ প্রতিরোধী কোষ তৈরি করতে সাহায্য করে, যা রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও এটি প্রদাহ কমাতে, ক্ষত সারাতে ও ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
ভিটামিন A রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্যঃ
ভিটামিন A-ও একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা পাট শাকে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। ১ কাপ (৮৭ গ্রাম) রান্না করা পাট শাকে ২৫৯ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন A থাকে। যা প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক প্রয়োজনের ২৫% পূরণ করতে সক্ষম।
ভিটামিন A রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি রোগ প্রতিরোধী কোষ তৈরি ও কোষের নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। সংক্রমণ বা ইনফ্লামেশন নিরাময়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
তবে, পাট শাক খাবার হিসেবে প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি এর পুষ্টিগুণ কে প্রভাবিত করতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুকানোর ফলে পাট শাকের পাতার প্রোভিটামিন A-ক্যারোটিনয়েড কমে যায়। আর বেশি সময় ধরে সেদ্ধ করলে পুষ্টিগুণ আরও কমে যেতে পারে।
সারাংশঃ পাট শাকে থাকা ভিটামিন C ও A শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। ভিটামিন C সংক্রমণ প্রতিরোধ, ক্ষত সারানো ও ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। আর ভিটামিন A রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি করে।
পাট শাক অভ্যন্তরীণ বা ইন্টারনাল রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ করেঃ
পাট শাক ভিটামিন K সমৃদ্ধ, যা রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে। এটি জন্ডিস ও পুষ্টি শোষণের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত পাট শাক খেলে কোলাইটিস, ক্রনিক রোগ সহ অন্যান্য সাধারণ রোগের ঝুঁকি কমে।
চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে পাট শাকঃ
পুষ্টির অভাব ও অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস চোখের সমস্যার অন্যতম কারণ। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন B6, ফলেট ও ভিটামিন এ সহ অন্যান্য ভিটামিন চোখের সমস্যা ও অন্ধত্ব প্রতিরোধে সহায়ক।
পাট শাকে ০.৪৯৬ মিগ্রা ভিটামিন B6 থাকে, যা আমাদের দৈনিক প্রয়োজনের ৩৮.১৫% পূরণ করতে সক্ষম।

রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম প্রতিরোধ করে পাটের শাকঃ
শরীরে আয়রনের বা লৌহের ঘাটতি থাকলে রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম হতে পারে। রেস্টলেস লেগ সিনড্রমে চিকিৎসকরা সাধারণত আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেন। তবে আয়রন সাপ্লিমেন্ট এর বিকল্প হিসেবে পাট শাক খেলে উপকার পাওয়া যায় কারণ এটি আয়রনসমৃদ্ধ।
পাট শাকের প্রতি ১০০ গ্রামে ৭.২-৭.৭ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে। যা আমাদের দৈনিক প্রয়োজনের ৩৪.১৩% পূরণ করতে সহায়ক। প্রকৃতপক্ষে পর্যাপ্ত আয়রন গ্রহণ করলে মাংসপেশির খিঁচুনিও অনেকাংশে কমে।
সারাংশঃ পাট শাকে থাকা ভিটামিন K অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ রোধে সহায়তা করে ও রক্ত খরন জনিত রোগের ঝুঁকি কমায়। এতে থাকা ভিটামিন A, B6 ও ফলেট চোখের স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখতে কার্যকর।পাট শাক ম্যাগনেসিয়াম ও আয়রনসমৃদ্ধ হওয়ায় রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম প্রতিরোধেও সহায়তা করে।
পাট শাক কোষের বৃদ্ধি ও ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখেঃ
পাট শাকে প্রচুর ভিটামিন A রয়েছে। যা ত্বক ও কোষের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও পাট শাক নিম্ন লিখিত উপকার করেঃ
- ক্ষত নিরাময় ও ত্বকের পুনর্গঠনে সহায়তা করে।
- অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কোষের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- পাট শাক ত্বকের ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
- নিয়মিত পাট শাক খেলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে ব্রনের দাগ, বলিরেখা কমতে সাহায্য করে।
- পাটশাকে থাকা ভিটামিন A চুলের স্বাস্থ্য রক্ষা করতেও কার্যকর ভূমিকা রাখে।
ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখেঃ
পাট শাকের প্রতি ১০০ গ্রামে ০.২২২ মিগ্রা তামা বা কপার থাকে থাকে, যা প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক চাহিদার ২৪.৬৭% পূরণ করে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, তামা (Copper) খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এবং ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
Flu বা ফ্লু প্রতিরোধে সহায়কঃ
পাট শাক ভিটামিন C সমৃদ্ধ। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি ভাইরাস ও ঠান্ডাজনিত সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদের শরিরকে সাহায্য করে।
আমরা জানি ফ্লু-FLU বা সর্দি তে ভিটামিন C গ্রহণ করলে ফুসফুসের সংক্রমণ ও নিউমোনিয়ার মত জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সারাংশঃ পাট শাকে থাকা ভিটামিন A কোষের বৃদ্ধি ও ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ব্রণ, দাগ ও বলিরেখা কমাতে সহায়ক। এতে থাকা কপার খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদয়স্বাস্থ্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। ভিটামিন C-এর কারণে পাট শাক Fluও ঠান্ডাজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধেও কার্যকর ভূমিকা রাখে।
পাট শাক ক্যানসার প্রতিরোধ করতে ভূমিকা রাখেঃ
পাট শাকে ভিটামিন B9 থাকে যা ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এটি সার্ভিক্যাল ক্যানসার, কোলন ক্যানসার ও ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধে বেশ কার্যকর।
পাট শাকের প্রতি ১০০ গ্রামে ৯০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন B9 থাকে। যা আমাদের দৈনিক প্রয়োজনের ২২.৫০% পূরণ করে। এজন্য চিকিৎসকরাও পাট শাক গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
পাট শাক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুরঃ
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে পাট শাক ভিটামিন E, A এবং C-তে সমৃদ্ধ। এ গুলী শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং কোষগুলোকে ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। আমরা সকলেই জানি ফ্রি র্যাডিক্যাল ক্যান্সার কোষ তৈরি করে। সেই সাথে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারনে পাট শাক দৃষ্টিশক্তি ও প্রজনন ক্ষমতা উন্নত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

পাট শাক হজম শক্তি উন্নত করেঃ
হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে বহু প্রাচীন কাল থেকেই পাট শাক গ্রামীণ জনপদে ব্যাবহার হয়ে আসছে। পাট শাক ফাইবার বা আঁশে সমৃদ্ধ। যা পরিপাকতন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে।
নিয়মিত পাট শাক খাওয়ার ফলে –
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়
- পায়খানা স্বাভাবিক হয়
- হজম প্রক্রিয়া দ্রুত হয়
- পেটে গ্যাস ও ক্র্যাম্পের সমস্যা কমে
আমরা জানি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে পুষ্টি শোষণের ক্ষমতা বাড়ে এবং পরিপাকতন্ত্র সুস্থ থাকে।
পাট শাক ওজন কমাতে সহায়কঃ
পাট শাকে এমন অনেক উপাদান রয়েছে যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও পাট শাকে উচ্চ মাত্রার ফাইবার বা আঁশ থাকায় হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং দীর্ঘ সময় পেট ভরার অনুভূতি দেয়। ফলে ক্ষুধা কম লাগে এবং কম খাবার গ্রহন করার জন্য শরীরের ওজন ও বাড়ে না। তাই যারা অল্প আহারের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রন করতে চান তারা নিয়মিত পাট শাক খেতে পারেন।
সারাংশঃ পাট শাকে থাকা ভিটামিন B9 ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এটি ফাইবারসমৃদ্ধ হওয়ায় হজম শক্তি বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। পাট শাক দীর্ঘক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে বলে ক্ষুধার অনুভূতি কম হয় ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
পাটের শাক ঘুমের মান উন্নত করেঃ
যারা ঘুমের সমস্যা, অনিদ্রা বা স্লিপ অ্যাপনিয়ার মত রোগে ভুগছেন তাদের জন্য পাট শাক উপকারী হতে পারে।
পাট শাকে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে। যা ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন মেলাটোনিন নিঃসরণে সাহায্য করে। এছাড়াও ম্যাগনেশিয়াম স্নায়ুকে শান্ত ও রিল্যাক্স করতে সহায়তা করে, ফলে গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম হয়।
তাই অনেক গবেষণাতে দেখা গেছে নিয়মিত পাট শাক খেলে নিদ্রাহীনতা ও স্লিপ ডিজ-অর্ডার কমে।
লিপিড ডিস-অর্ডার কমাতে সাহায্য করে পাট শাকঃ
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে তামা বা কপার “খারাপ” কোলেস্টেরল (LDL কোলেস্টেরল) কমাতে সাহায্য করে এবং ভাল কোলেস্টেরল (HDL কোলেস্টেরল) বাড়াতে সহায়তা করে। পাট শাকে 0.২২২ মিগ্রা তামা থাকে, যা দৈনিক দৈহিক চাহিদার পরিমাণের ২৪.৬৭%।
এ ছাড়াও পাট শাক অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস (Atherosclerosis), হার্ট রোগ এবং স্ট্রোক এর মতো কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
সারাংশঃ পাট শাকে থাকা ম্যাগনেশিয়াম ঘুমের মান উন্নত করে এবং নিদ্রাহীনতা কমাতে সাহায্য করে। এতে থাকা কপার খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে। পাট শাক নিয়মিত খেলে স্নায়ু শান্ত থাকে ও গভীর ঘুম নিশ্চিত হয়।
গর্ভাবস্থায় পাট শাকের উপকারিতাঃ
- পাট শাকে থাকা ফোলেট বা ভিটামিন B9 ভ্রূণের নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে ও নিউরাল টিউব ডিফেক্ট এর মত রোগ প্রতিরোধ করে।
- এতে থাকা প্রচুর পরিমানে আয়রন-রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশুর হাড়ের গঠন উন্নত করে ও মায়ের ঘুমের মান উন্নত করে।
- গর্ভাবস্থায় সাধারণ সমস্যা কোষ্ঠকাঠিন্য পাট শাকে থাকা আঁশ এর কারনে দূরীভূত হয় ।
- পাট শাকে থাকা প্রচুর পরিমানে ভিটামিন C ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
পাট শাকের পুষ্টিগুণঃ
নিম্নে ১ কাপ (২৮ গ্রাম) কাঁচা পাট শাক ও ১ কাপ (৮৭ গ্রাম) রান্না করা পাট শাকের পুষ্টিগুণ তুলনা মূলক ভাবে নিচে দেওয়া হলোঃ
পুষ্টি উপাদান | এক কাপ কাঁচা (২৮ গ্রাম) | এক কাপ রান্না করা (৮৭ গ্রাম) | প্রতি ১০০ গ্রামে |
ক্যালোরি | ১০ কিঃক্যালরি | ৩২ কিঃক্যালরি | ৪৩-৫৮ কিঃক্যালরি |
প্রোটিন | ১ গ্রাম | ৩ গ্রাম | ৪.৫-৫.৬ গ্রাম |
ফ্যাট | ০.০৭ গ্রাম | ০.১৭ গ্রাম | ০.৩ গ্রাম |
কার্বোহাইড্রেট | ২ গ্রাম | ৬ গ্রাম | ৭.৬-১২.৪ গ্রাম |
ফাইবার | ১ গ্রাম | ২ গ্রাম | ১.৭-২.০ গ্রাম |
ক্যালসিয়াম (Ca) | ৪% R.D.I | ১৪% R.D.I | ২৬৬-৩৬৬ মিঃগ্রাম |
আয়রন (Fe) | ৭% R.D.I | ১৫% R.D.I | ৭.২-৭.৭ মিঃগ্রাম |
ম্যাগনেসিয়াম (Mg) | ৪% RDI | ১৩% R.D.I | – |
পটাশিয়াম (K) | ৩% R.D.I | ১০% R.D.I | ৪৪৪ মিঃগ্রাম |
ভিটামিন সি | ১২% R.D.I | ৩২% R.D.I | ৫৩-৮০ মিঃগ্রাম |
রিবোফ্লাভিন বি২ | ১২% R.D.I | ১৩% R.D.I | ০.২৬-০.৫৩ মিঃগ্রাম |
ফলেট | ৯% R.D.I | ২৩% R.D.I | – |
ভিটামিন এ | ৯% R.D.I | ২৫% R.D.I | ৬.৪১-৭.৮৫ মিঃগ্রাম |
সোডিয়াম (Na) | – | – | ১২ মিঃগ্রাম |
ফসফরাস (P) | – | – | ৯৭-১২২ মিঃগ্রাম |
নিয়াসিন | – | – | ১.১-১.২ মিঃগ্রাম |
থায়ামিন বি১ | – | – | ০.১৩-০.১৫ মিঃগ্রাম |
বিঃ দ্রঃ কাঁচা পাট শাকের তুলনায় প্রায় ৩ গুন পুষ্টি থাকে রান্না করা পাট শাকে।
পাট শাকের অপকারিতাঃ
সাধারনত পাট শাকের কোন মারাত্মক ক্ষতিকর দিক নেই। তবে অধিক পরিমানে খেলে বদহজম হতে পারে। যদিও পাট শাক প্রধান এলার্জি জাতীয় খাদ্যের মধ্যে পড়ে না। তবে যদি খাওয়ার পর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাহলে এগুলি পরিহার করা উচিৎ।
যদি খাওয়ার পর কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে অথবা ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। এছাড়াও ইতিপূর্বে পাট শাকে যাদের অ্যালার্জির পূর্ব ইতিহাস আছে তাদের পাট শাক এড়িয়ে চলাই ভালো।
সারাংশঃ যাদের পাট শাকে এলার্জি রয়েছে, তাদের উচিত পাট শাক সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা। এলার্জি জনিত প্রতিক্রিয়া হলে আপনার নিকটস্থ স্বার্থ সেবা কেন্দ্র দ্রুত যোগাযোগ করুন।
শেষ কথাঃ
পাট শাক একটি জনপ্রিয় এবং বহুমুখী ব্যবহার উপোজুগি শাক। পাটশাকের সাথে পাতলা ডাল গ্রাম গঞ্জের অতি জনপ্রিয় একটি রেসিপি। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষাকারী অনেক পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ খাবার। আমাদের দেশের সস্তা ও অবহেলা করা এই শাক আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
তাই অবহেলা না করে আসুন নিয়মিত পাট শাক খাই নীরোগ ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করি। পাটশাক খেলে কি উপকার হয় সে সম্পর্কিত আর্টিকেলটি কেমন লাগলো কমেন্ট সেকশনে জানান। আপনার করা মতামত ও গঠনমূলক সমালোচনা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে।