আপনি কি জানেন? পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা কি?
আমাদের অনেক সুপরিচিত সবজি পটল। পটল দিয়ে বানানো অনেক সবজি আমরা খেয়ে থাকি এটা অনেক সুস্বাদু। যেমন-পটল পোস্ত, পটল-ইলিশ,পটলের দোলমা, পটলের ভর্তা, পটল ভাজি। এমনকি পটলের চামড়াটা বা খোসা ফেলে দেওয়ার নয়। পটলের চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু ভর্তা। সাধারণত এই সবজি গ্রীষ্মকালে পাওয়া গেলেও এখন প্রায় সারা বছরই আমরা বাজারে পটল পেয়ে থাকি। পটল কে ইংরেজিতে (Potol in english) pointed gourd বা Parwal বলে।
আসুন এই আর্টিকেলে আমরা সবিস্তারে জানবো (Potol vegetable) পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে।
পটলের উপকারিতাঃ
পটলের অনেক উপকারী দিক রয়েছে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে পটল এর ডায়াবেটিস, ক্ষতিকর হাইপার লিপিডেমিয়া, টিউমার বিরোধী, সাইটোটক্সিক, আর্সেনিক রোগ প্রতিরোধী, এন্টি ইনফ্লামেটরি বা প্রদাহ বিরোধী,এন্টিফাঙ্গাল বা ছত্রাক বিরোধী , ব্যাকটেরিয়া বিরোধী, ডায়রিয়া প্রতিরোধী, এবং বিভিন্ন চর্ম রোগ প্রতিরোধী খাবার হিসেবে বিরাট ভূমিতে আছে।
আরও পড়ুনঃ আপনি জানেন কি? শাক আলুর উপকারিতা ও অপকারিতা !
এগুলো ছাড়াও পটলের অনেক উপকারী দিক নিচে তুলে ধরা হলো:
ব্যাথা নাশকঃ
প্রাকৃতিক ব্যাথা নাশকহিসেবে পটলের জুড়ি মেলা ভার। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাণীর উপর এক গবেষণায় দেখা গেছে মাথাব্যথা ও পেটের সংকোচনজনিত ব্যথায় পটল বেশ কার্যকরী। এমনকি প্রচলিত ব্যাথা নাশক এসপিরিন এর তুলনায় ৪১% থেকে ৬৩% পর্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে।
কৃমিনাশক হিসেবে কার্যকরঃ
পটলের কৃমিনাশক গুণ রয়েছে। প্রাকৃতিক কৃমি নাশক হিসেবে পটল এর বীজ অনন্য ভূমিকা পালন করে। বিশেষকরে পটল বীজ কৃমিনাশক ঔষধ পাইপেরাজিন সাইট্রেট এর মত বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
সামারিঃ প্রাকৃতিক ব্যাথা নাশক ও কৃমিনাশক হিসেবে পটল ও পটলের বীজ অনন্য ভূমিকা রাখে।
ডায়াবেটিসে বেশ কার্যকরঃ
অনেক ফার্মাকোলজিক্যাল গবেষণায় উঠে এসেছে যে পটলের বীজ এবং পাতা ডায়াবেটিস বিরোধী হিসেবে বেশ কার্যকর। সাম্প্রতিক সময়ে ইঁদুরের উপর গবেষণায় দেখা গেছে হালকা এবং মাঝারি মাত্রার ডায়াবেটিসে ও এর বিভিন্ন উপাদান খুবই কার্যকর।
আরো এক গবেষণায় উঠে এসেছে প্রতিদিন একনাগারে ২৮ দিন পর্যন্ত পটলের একোয়াস এক্সট্র্যাক্ট ১০০০ মিলি.গ্রাম/কেজি হিসেবে খেয়ে রক্তে ফাস্টিং ব্লাড গ্লোকোজ লেভেল, অ্যালকালাইন ফসফেট, ALT,AST, সিরাম ক্রিয়েটিনিন, ইউরিন সুগার, এলবুমিন কমানো সম্ভব হয়েছে। ডায়াবেটিস রোগীদের কমন একটি রোগ পেরিফেরাল ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি বা হাতে-পায়ে অবশষ অনুভব করা কমাতে পটল বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
সামারিঃ পটলের বীজ ও পটলের পাতা ডায়াবেটিসে খুব ভালো ভূমিকা রাখে। এছাড়াও ডায়াবেটিস এর ফলে হওয়া পেরিফেরাল ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর ভালো উৎসঃ
পটলে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা ফ্রি র্যাডিকেল তৈরিতে বাধা দেয় এবং ক্ষতস্থান সারাতে সাহায্য করে।বিভিন্ন গবেষণায় পটলের ফল,লতা ও কান্ডে এন্টিঅক্সিডেন্ট, আন্টি ইনফ্লামেটরি এবং জ্বর প্রতিরোধী উপাদান পাওয়া গেছে।
এছাড়াও আর্সেনিকের ফলে মানুষের শরীরে হওয়া মায়োকার্ডিয়াল টক্সিসিটি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
সামারিঃ পটলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা ফ্রী রেডিকেল প্রতিরোধ করে। যার ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধ হয়।
হজম ক্রিয়া স্বাভাবিক করেঃ
পটল কম ক্যালরিযুক্ত হলেও ভিটামিন ও ডায়েটারি ফাইবারের খুব ভালো উৎস। এটি হজম ক্রিয়া স্বাভাবিক করার সাথে সাথে পেটের বাওয়েল মুভমেন্ট স্বাভাবিক রাখে।
পটল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করেঃ
সাম্প্রতিক সময়ে কোষ্ঠকাঠিন্য অনেকেরই ক্রনিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সময় মত প্রতিকার না করলে তা বড়সড় সমস্যায় রূপান্তরিত হতে পারে।এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য হোটেলের বীজ খুবই কার্যকর।
সামারিঃপটল কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে ও হজম ক্রিয়া স্বাভাবিক করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
ওজন কমাতে সাহায্য করেঃ
ওজন বৃদ্ধি বর্তমান বিশ্বের একটি মারাত্মক সমস্যা। বিভিন্ন ধরনের জাঙ্ক ফুড এবং ওয়েস্টার্ন খাদ্য অভ্যাস দিনকে দিন অবেসিটি বা মুটিয়ে যাওয়ার মত সুদূরপ্রসারী সমস্যার সৃষ্টি করছে। অধিক ওজন বৃদ্ধি বা মুটিয়ে যাওয়া অনেক জটিল রোগের মূল কারণ। যেমন:হার্টের রোগ,ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে পটল কম ক্যালরিযুক্ত ও উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাবার। তাই যারা ওজন কমাতে ইচ্ছুক তারা এই কম ক্যালরিযুক্ত পটল খেয়ে ওজন কমাতে পারেন।
পটল রক্ত পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করেঃ
আয়ুর্বেদ চিকিৎসার শাস্ত্র মতে পটল রক্ত পরিষ্কার হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ পটল শরীরকে ডিটক্সিফিকেশন এর মাধ্যমে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
সামারিঃপটল রক্ত পরিষ্কারক ও ওজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। পটল কম ক্যালরিযুক্ত ও উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাবার। তাই যারা ওজন কমাতে ইচ্ছুক তারা এই কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খেয়ে ওজন কমাতে পারেন।
সাধারণ জ্বর কমায়ঃ
রক্তের শর্করা বা গ্লোকোজ পরিমাণ কমানোর সাথে সাথে পটলের বীজ রক্তের অধিক পরিমাণে থাকা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। পটলের বীজ রক্তের LDL বা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমায় এবং ভালো কলেস্টেরল বা HDL বাড়ায়।
সাধারণ জ্বর কাশি নিরাময়ে ভূমিকা রাখেঃ
সারা বছর অনেকেই বিভিন্ন ধরনের Flu তে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। আয়ুর্বেদ মতে এই Flu থেকে পরিত্রাণের জন্য পটল খুবই কার্যকরী। বিশেষ করে ইমিউনিটি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে পটল আমাদের শরীরে এই কার্যকর ক্ষমতার প্রদর্শন করে। ভিটামিন সি অধিক পরিমাণে থাকার কারণে পটল সাধারণ সর্দি-কাশি ও জ্বরে বেশ কার্যকর। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে জ্বর কাশি নিরাময়ের ওষুধ হিসেবে বহু প্রাচীনকাল থেকে পটল ব্যবহার হয়ে আসছে।
সাধারণত কমন কোল্ড শরীরের জন্য খুব বেশি ক্ষতির কারণ না হলেও অনেক অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা মতে এই সাধারণ জ্বর ও কাশিতে পটল বেশ ভালো ভূমিকা রাখে। এতে থাকা ভিটামিন সি সাধারণ জ্বর কাসিতে বেশ কার্যকর ওষুধ হিসেবে পটল বহু আদি কাল থেকেই অধিক জ্বর,স্বরভঙ্গ ও মাথা ব্যথায় বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে।
আর ও পড়ুনঃপুষ্টিকর গিমা শাকের ভাজি রেসিপি
পটলের রয়েছে আন্টি এজিং গুনাগুনঃ
অধিক উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন-ই ভিটামিন-এ ভিটামিন-সি থাকায়, তা ত্বকের কুঁচকিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে ফলে ত্বক টানটান থাকে এবং শরীরে বয়সে ছাপ পরতে দেয় না।
সামারিঃপটল রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমানোর সাথে-সাথে আন্টি-এজিং ও সাধারণ জ্বর কাশি নিরাময়ে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জন্ডিস ও লিভার ফাংশনের জন্য খুব কার্যকরঃ
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রে জন্ডিস ও লিভার এর কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য পটল বিশেষ ভূমিকা রাখে এর পাতা বীজ এবং ফল লিভারের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এন্টি ব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করেঃ
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রে মতে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিভিন্ন রোগে পটলের পাতা বীজ এবং ফল কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
রুচি বর্ধক হিসেবে কার্যকরঃ
অরুচির চিকিৎসায় বহু প্রাচীনকাল থেকে পটল গুরুত্বপূর্ণ। পটলের বিভিন্ন পদ অরুচির নিরাময় কারক হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রে বহু প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে।
সামারিঃ পটল জন্ডিস ও লিভার ফাংশনের বিভিন্ন সমস্যা ও মদ্য পানের ফলে হওয়া লিভারের বিভিন্ন রোগ নিরাময় সহ রুচি বর্ধক হিসেবে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পটলের অপকারিতাঃ
আধুনিক গবেষণায় পটলের মারাত্মক ধরনের কোন অপকারিতা পরিলক্ষিত হয়নি। তবে যাদের পটলে অ্যালার্জি আছে তাদের ক্ষেত্রে পটল পরিহার করে চলায় ভালো। তবে অধিক পরিমাণে খেলে পেটে বাতাস জমে এবং পেটে ব্যথা বা পীড়া হয়। অনেকের ক্ষেত্রে বমি বমি ভাবও হতে পারে তবে অধিক পরিমাণে একসাথে না খেলে মারাত্মক ধরনের কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।
পটলের পুষ্টিগুণঃ
পটল এর ১০০ গ্রাম এ যেসব পুষ্টি উপাদান থাকে সেগুলান নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
ক্যালরি | ২০ কিঃ ক্যাল |
ফ্যাট | ০.৩ গ্রাম |
শর্করা | ২.২ গ্রাম |
প্রোটিন | ২ গ্রাম |
ক্যালসিয়াম | ৩০ মিঃ গ্রাঃ |
আয়রন | ১.৭০ মিঃ গ্রাঃ |
ফসফরাস | ৪০ মিঃ গ্রাঃ |
পটাসিয়াম | ১৫০ মিঃ গ্রাঃ |
ম্যাগনেসিয়াম | ১১ মিঃ গ্রাঃ |
ফাইবার | ৩ গ্রাম |
বেটা ক্যারোটিন- ভিটা-এ | ২.২ মাইক্রো.গ্রাম |
শেষ কথাঃ
আমাদের সুপরিচিত ও জনপ্রিয় এই সবজিটি স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। জেনে বা না জেনে অতি প্রাচীনকাল থেকেই আমরা এই সবজিটি খেয়ে আসছি। আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রে ও পটলের গুরুত্ব অনেক। তাই আসুন পটলের সঠিক গুন জানার পরে আমাদের খাদ্য তালিকায় নিয়মিত এই সবজিটির রাখি এবং এর গুণের মাধ্যমে উপকৃত হয়ে অনেক রোগ প্রতিরোধ করি।
পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কিত আমাদের আর্টিকেলটি কেমন লাগলো কমেন্ট সেকশনে জানান। এছাড়াও আর কি কি বিষয় জানতে চান তাও জানাতে পারেন। আপনার সুচিন্তিত মতামত আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে।