আপনি জানেন কি? শাক আলুর উপকারিতা ও অপকারিতা !
শাক আলু শীতকালীন মূল জাতীয় সবজি। আমাদের দেশে এ মূল জাতীয় সবজি শাকালু, কেশর আলু বা কেশুর আলু নামেও পরিচিত। কেসর আলু / শাখআলু / কেশর আলু কে English এ Yambean বা Goitenyo বা Jicama বলে। শাখ আলু গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Pachyrhizus Tuberosus.
আদি নিবাস মেক্সিকোতে হলেও সুমিষ্টই মূল জাতীয় সবজিটি দক্ষিণ এশিয়াতেও বেশ জনপ্রিয়। আসুন এই আর্টিকেলে শাক আলুর উপকারিতা ও অপকারিতাসহ কেন এই সবজি আমাদের খাওয়া উচিত এ বিষয়ে সবিস্তারে জানি।
কেশর আলু খাওয়ার উপকারিতা (Sakh Alu Benefits)
শাক আলুর উপকারিতা অনেক। নিচে শাক বা কেশর আলুর উপকারিতা তুলে ধরা হলোঃ
শাকালু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর ভালো উৎসঃ
আমরা সকলেই জানি সেল ডেমেজ কমানোর জন্য এন্টিঅক্সিডেন্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ১৩০ গ্রাম বা এক কাপ শাক আলু দৈনিক চাহিদার অর্ধেক ভিটামিন সি পূরণ করতে সক্ষম। এছাড়াও ভিটামিন ই ,সেলেনিয়াম এবং বেটা ক্যারোটিন থাকে। অবশ্যই ড্যামেজ প্রতিরোধের মাধ্যমে শরীরের ফ্রি রেডিকেল তৈরি হতে বাধা দেয়।
ফ্রি রেডিকেল হলো ক্ষতিকর উপাদান যা শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বৃদ্ধি করার মাধ্যমে শরীরকে অসুস্থ করে। সাথে মারাত্মক রোগ যেমন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এই শাক আলু।
আরও পড়ুন – গাজরের ১০১ঃগাজর খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
কেশর আলু হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়ঃ
শাক আলুতে থাকা বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদরোগ, মোটিয়ে যাওয়া বা ওবেসিটি, ডায়াবেটিস এবং অ্যালজাইমারের ঝুঁকি কমায়। হৃদরোগ প্রতিরোধে শাক আলু বা কেসর আলুর ভুমিকা অনন্য।এছাড়াও এতে থাকা দ্রবীভূত ফাইবার ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমানোর মাধ্যমে হার্টকে সুস্থ রাখে।
শাক আলুর পটাশিয়াম এর কারণে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে। সেই সাথে stroke হওয়ার আশঙ্কা কমে। আয়রন ও কপার থাকার কারণে ব্লাড সার্কুলেশন খুব ভালো হয়। এছাড়াও অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে কেশুর ফল হার্ট এর রক্ত জমাট বা Blood clotting এ বাধা প্রদানের মাধ্যমে হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
সামারিঃ শাক আলু বা কেসর আলুতে প্রচুর ফাইবার, পটাশিয়াম,আয়রন ও কপার থাকে যা হার্টকে সুস্থ রাখার মাধ্যমে, হার্টের রোগ প্রতিরোধ করে।
কেসর আলু হজম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখেঃ
শাঁখ বা কেসর আলুতে প্রচুর ফাইবার থাকে যা মলকে স্বাভাবিকভাবে কোলন থেকে নিঃসরণ করতে সহায়তা করে।
১৩০ গ্রাম শাক আলুতে ৬.৪ গ্রাম ফাইবার থাকে যা আপনার দৈনিক চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখে। কেশর আলুতে থাকা ইনুলিন নামক ফাইবার পরিপাকতন্ত্রের বাওঅয়েল মুভমেন্ট প্রায় ৩১% বাড়িয়ে দেয়।ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে না। এছাড়াও কেসর আলুতে থাকা জলীয় অংশ আপনার শরীরের তরলের ব্যালেন্স স্বাভাবিক রাখে।
সামারিঃ শাকালুতে থাকা প্রচুর ফাইবার এবং পানি ইন্টেস্টাইনের স্বাভাবিক মুভমেন্ট এ সাহায্য করে।
কেশুর আলু গাট ব্যাকটেরিয়ার জন্য ভালোঃ
শাক আলু বা কেশুর আলুতে ইনুলিন থাকে। যা এক ধরনের প্রিবায়োটিক ফাইবার। প্রিবায়োটিক হলো আমাদের পাকস্থলীর গাটে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া বা প্রোবায়োটিকস এর খাবার।
প্রিবায়োটিকের স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব অনেক। প্রিবায়োটিক ছাড়া গাটের উপকারী ব্যাকটেরিয়া কমে যায় বা তৈরি হয় না। আর গাটের প্রোবায়োটিক কমে গেলে আমাদের হজম প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। সেই সাথে ইনুলিন গাটের উপকারী ব্যাকটেরিয়া বা প্রোবায়োটিকস এর সংখ্যা বাড়ায় ফলে অপকারী ব্যাকটেরিয়া সংখ্যার হ্রাস পায়।বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে প্রোবায়োটিক আপনার ওজন, রোগ প্রতিরোধ সিস্টেম এমনকি মন বা মুডের উপর ও প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়াও প্রোবায়োটিকস হার্ট, কিডনি , ডায়াবেটিস,ওবেসিটি,বা স্থুলতার মতো ক্রনিক ডিজিজ প্রতিরোধে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
সামারিঃ কেশর আলু বিভিন্ন প্রিবায়োটিক ফাইবারের ভালো উৎস। উপকারী ব্যাকটেরিয়া স্থুলতা,হৃদরোগ,ডায়াবেটিস,কোষ্ঠকাঠিন্য এর মত ক্রনিক ডিজিজ প্রতিরোধে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
শাঁখ আলু ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেঃ
কেশর আলু বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর আধার। ভিটামিন সি, ভিটামিন ই এবং সিলেনিয়ামের ভালো উৎস। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফ্রি রেডিকেল নিষ্ক্রিয়করণের মাধ্যমে সেল ড্যামেজ ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
কেশুর আলু ডায়াটারি ফাইবার ভালো উৎস হওয়ায় কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক গবেষণায় দেখা যায় যারা প্রতিদিন ২৭ গ্রাম এর বেশি ডায়েটারি ফাইবার গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে ৫০% এর বেশি ব্যক্তির কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমেছে। গাটে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিকরণ এর মাধ্যমেও কেশুর আলু ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। রোগ প্রতিরোধী শর্টচেইন ফ্যাটি এসিডের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
প্রকৃতপক্ষে ইঁদুরের উপর করা গবেষণায় দেখা গেছে ইনুলিন নামক ফাইবারের কারণে ইঁদুরগুলো কোলন ক্যান্সার থেকে মুক্ত ছিল। আসলে ইনুলিন এখানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছে।
সামারিঃ কেশুরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইবার ও প্রিবায়োটিক ক্যান্সার প্রতিরোধে মস্ত বড় ভূমিকা পালন করে।
শাঁক আলু ওজন কমাতে সাহায্য করেঃ
কেশর বা শাঁক আলু অত্যধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার এতে প্রচুর পুষ্টি উপাদান থাকলেও তুলনামূলক কম ক্যালোরি থাকে কেশোর আলুতে থাকা প্রচুর জলীয় ও উপাদান ও ফাইবার আপনার ক্ষুধা অল্পতে মিটিয়ে দেয়। এতে থাকা ফাইবার ব্লাড সুগার কে দ্রুত বাড়তে দেয় না । ফাইবার হজম ধীরগতি করে ফলে ক্ষুধা কম লাগে এবং ব্লাড সুগার খুব দ্রুত উচ্চ মাত্রায় উন্নীত হয় না।
ইনসুলিন রেজিস্টেন্স ওজন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। ইঁদুরের উপর গবেষণায় দেখা গেছে কেশর আলু ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বৃদ্ধি করে এবং রক্তের গ্লোকোেজর মাত্রা কমায়। প্রিবায়োটিক ফাইবার ইনুলিনের কারণে ওজন হ্রাস পায় সাথে হরমোনের ব্যালেন্স ঠিক থাকে। কেশর আলু খাওয়ার কারণে যে শুধুই গাট ব্যাকটেরিয়া বাড়ায় আর ওজন হ্রাস করে তা নয় এটা খাওয়ার পরে ক্ষুধার অনুভূতিও কম হয়।
সামারিঃ পুষ্টিকর কেসর আলু কম ক্যালরিযুক্ত ও উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাবার। রক্তে সুগার ওজন কমাতে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শাক আলুর অপকারিতাঃ
শাকালু খুবই পুষ্টিকর খাবার হলেও এর সামান্য কিছু অপকারী দিকও আছে, নিচে তা তুলে ধরা হলোঃ
- শাক আলু বা কেশর আলুর মূল বা শাঁস ছাড়া বাকি অংশ যেমনঃ পাতা, বীজ , ফুল এ রোটেনন নামক বিষাক্ত উপাদান থাকে। তাই ভেতরের মূল বা শাঁস ছাড়া শাক আলুর কোন অংশই খাওয়া যায় না।
- প্রচুর ফাইবার থাকায় একবারে অধিক পরিমাণে শাক আলু বা কেশর আলু খেলে পেটের পীড়া হতে পারে। যেমনঃ পেটে ব্যথা, অস্বস্তি বোধ হওয়া, পেট ভারী বোধ করা।
- শাক আলুর উপরের চামড়াতে ও বিষাক্ত রোটেনন নামক উপাদান থাকে। তাই কেসর আলু খাওয়ার সময় ভালো করে ধুয়ে এবং ছাল ছাড়িয়ে খেতে হবে।
- অধিক পরিমাণে একবারে খেলে অন্যান্য মিনারেলস যেমন ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিংক,এবং ম্যাগনেসিয়াম এর শোষণ কমে যায়।
- IBS (Irritable bowel syndrome) এর রোগীদের ক্ষেত্রে অধিক খেলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে তাই সতর্কতার সাথে খাওয়া উচিত।
- কেশর আলুতে যাদের এলার্জি থাকে তাদের ক্ষেত্রে এলার্জিক রিয়াকশন হতে পারে। যেমন মুখ,জিহব্বা,শরীর লাল হওয়া ও চুলকানো।
- এছাড়াও টক্সিক মাটি যেগুলোতে হেভি মেটাল থাকে সেখানে উৎপাদিত কেসর আলু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই দূষিত মাটি ও পানির মাধ্যমে উৎপাদিত কেশর না খাওয়াই ভালো।
তবে নিয়ম মেনে খোসা ছাড়িয়ে শাক আলু পরিমিত পরিমাণে খেলে এর অপকারিতা নেই উপকারী দিকটাই বেশি।
সামারিঃ শাক-আলু পরিমিত পরিমানে খেলে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তবে অধিক পরিমাণে খেলে গ্যাস পেটে ব্যথা হতে পারে। এছাড়াও শাক আলু বা কেসর আলুর ছাল ছাড়ানো মূল ছাড়া এর পাতা বীজ ও চামড়া তে বিষাক্ত উপাদান থাকে। তাই ভেতরের শাঁসাল অংশটুকুই খাওয়া স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর।
কেশুর আলু বা কেসর আলুর পুষ্টি উপাদানঃ
কেশুর আলুর মূল পুষ্টি উপাদান কার্বস। খুব অল্প পরিমাণে প্রোটিন ও ফ্যাট থাকে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক ভিটামিন ও মিনারেলস এর উৎস এই কেশর আলু।এছাড়াও শাক আলুতে প্রচুর ফাইবার বা আস থাকে।
এক কাপ বা ১৩০ গ্রাম শাঁখালুতে থাকেঃ
- ক্যালরিঃ ৪৯ kcal
- কার্বসঃ ১২ গ্রাম
- প্রোটিনঃ ১ গ্রাম
- ফ্যাটঃ ০.১ গ্রাম
- ফাইবারঃ ৬.৪ গ্রাম
- ভিটামিন সিঃ ৪৪% RDI
- ফলেটঃ ৪% RDI
- আয়রনঃ৪% RDI
- ম্যাগনেসিয়ামঃ৪% RDI
- পটাসিয়ামঃ ৬% RDI
- মাঙ্গানিজঃ৪% RDI
এছাড়াও কেশর আলুতে সামান্য পরিমানে ভিটামিন ই ( vitamin-E), থায়ামিন (B1), রিবোফ্লাভিন (B2), ভিটামিন (B6), প্যাণ্টোন্থেণিক অ্যাসিড,ফসফরাস,ক্যালসিয়াম, কপার ও জিংক থাকে।
শাখ আলুর ১৩০ গ্রাম এর মাধ্যমে পুরুষের দৈনিক প্রয়োজনীয় ফাইবারের ১৭% এবং নারীদের ক্ষেত্রে ২৩% পূরণ করা সম্ভব। শাক আলু ভিটামিন সি সহ অনেক পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন (Water soluble vitamin) এর উৎস হওয়াতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট (Anti-oxident) হিসেবে কাজ করে।যা শরীরের বিভিন্ন বিপাক্ক্রিয়া বা এনজাইম রিএকশন এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সামারিঃকেশুর আলু অনেক ভিটামিন ও মিনারেলসের আদর্শ উৎস। এছাড়াও এতে অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন থাকে।
শেষ কথাঃ
শাক বা কেসর আলু স্বাস্থ্যকর পুষ্টি সমৃদ্ধ হওয়ায় খাদ্য তালিকায় এটি রাখা উচিত।
এতে অনেক ধরনের পুষ্টি উপাদান, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন থাকে।শাক বা কেশর আলু হজম স্বাভাবিক করনের পাশাপাশি ওজন কমে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সুস্বাদু ও মজাদার এই মূল জাতীয় সবজিটি কাঁচা ও অন্যান্য খাবারের সাথে খাওয়া যায়। শাক আলুর ত্বক বা চামড়া পাতা ও বীজ বিষাক্ত তাই এই অংশ ছাড়া এই মূল জাতীয় সবজিটি আমাদের নিয়মিত খাওয়া উচিত।
উপরের লেখাটি কেমন লাগলো তা নিচের কমেন্ট সেকশনে জানাবেন। এছাড়াও আর কি কি বিষয়ে আপনারা জানতে আগ্রহী তা লিখে পাঠাতে পারেন। আপনাদের গঠনমূলক সমালোচনা আমাদেরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।